জন্মশতবর্ষেও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসনের নেই কোন আয়োজন। শৈলকুপায় নাচোল কৃষক বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মহয়সী বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র ছিলেন জমিদার কন্যা ও পুত্রবঁধু। তার পরিবার দেশবিভাগের বিরূপ পরিস্থিতিতে বাড়ি-জমিজমা বিক্রি করে চলে গেছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অদৃশ্য কোন কারণে পৈতৃক বাড়িটি সংরক্ষণে জেলা প্রশাসন নীরব বলে অভিযোগ আছে। ঐতিহাসিক নাচোল কৃষক বিদ্রোহের রানিমা খ্যাত ঝিনাইদহের ভূমিকন্যা ইলা মিত্র পৈতৃক ভিটা ও স্মৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আর্কাইভে কিছু তথ্য ও একটি ছবি যুক্ত করে। যা ডিসি অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কের দেওয়ালের সৌন্দর্যবর্ধন করছে। শৈলকুপা উপজেলা প্রশাসনের এ ব্যাপারে অবশ্য কোন আগ্রহ নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইলা মিত্র স্মরণে পৈতৃক বাড়ি বা কোন আয়োজন ও আর্কাইভ সংরক্ষণে কোন মনোযোগ নেই। অথচ সংরক্ষণের সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদাসীনতায় ধ্বংসপ্রায় নাচোল বিদ্রোহের কিংবদন্তি কমরেড ইলা মিত্রের শৈলকুপার পৈত্রিক বাড়ি। ইতিহাস বিখ্যাত নাচোল বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। প্রত্নসম্পদ ঘোষণার ৯ বছরেও দখলমুক্ত হয়নি ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক বাড়ি। ঐতিহাসিক নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র। যাকে বলা হয় নাচোলের রানিমা। নাচোল অঞ্চলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জে হলেও ভূমিকন্যা ইলা মিত্রের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে। এই গ্রামের পৈত্রিক বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রত্নসম্পদ হিসাবে ঘোষণা করে সরকারি গেজেট প্রকাশের প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও দখল মুক্ত করা যায়নি বাড়িটি। এই স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এ দাবি সব মহলের।
বাগুটিয়ার রায়পাড়া জরাজীর্ণ দ্বিতল ভবনটি নাচোল কৃষক আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের পৈত্রিক বাড়ি। জন্ম কলকাতায় হলেও কিংবদন্তি নেত্রীর ছোট বেলার বেশকিছুটা সময় কেটেছে এই বাড়িতেই। ১৭ শতক জমির উপর দোতলা ও একতলা দুটি ভবনে ৯টি কক্ষ আর একটি প্রধান ফটকযুক্ত ও শানবাঁধানো ঘাট-পুকুরসহবাড়িটি অযত্ন আর অবহেলায় এর অস্তিত্বই আজ বিলীন হওয়ার পথে। একটি ভবনের ছাদের অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে, দেয়ালে ধরেছে ফাটল। এছাড়া পৈতৃক স্থানটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা হওয়ার প্রায় ৯ বছরেও দখলমুক্ত করা হয়নি বাড়িটি। এমনকি যারা ভোগদখল করছেন তাদের বাঁধায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কোনো সাইনবোর্ডও দিতে পারেননি।
জানা গেছে, ঝিনাইদহের শৈলকুপা শহর থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ১৩ কিলোমিটার দুরের গ্রাম বাগুটিয়া। গ্রামের জরাজীর্ণ ও কর্দমাক্ত মেঠোরাস্তার পাশে চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা ৯টি কক্ষের কারুকার্যমন্ডিত নকশাকারে পুরনো ভবন। ১২৯৯ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই বাড়িটি নির্মাণ করেন ইলা মিত্রের ঠাকুরদাদা রাজমোহন সেন। পূর্বপুরুষেরা দেশত্যাগের পর বাড়িটি দখল হয়ে যায়। শুধু বাড়ি নয়, দখল করা হয়েছে ইলা মিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের রেখে যাওয়া শত-শত বিঘা জমি। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাড়িসহ ২২ শতক জমি সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই মাসেই গেজেটও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৯ বছরেও দখলমুক্ত করা হয়নি বাড়িটি। বসবাসকারীদের দাবি, বাড়িটি কিনে নেন জনৈক খোদাবক্স কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে বাড়িটির মালিক হন হাজী কিয়াম উদ্দিন। ১৯৭০ থেকে বাড়িটিতে বসবাস করছেন কিয়াম উদ্দিনের উত্তরসূরীরা। তারা বলছেন, ‘প্রতিবছরই আমাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত রাস্তাটিও সংস্কার করা হয়নি।’ লোকজন আসাতে তারা নাকি বিরক্ত ও হয়রানির স্বীকার হচ্ছে এমনটিও বলেন তৃতীয় প্রজন্ম আবু বকর।
নাচোল বিদ্রোহ ছিল ১৯৪৯ সালের শেষভাগ ও ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় সংঘটিত একটি কৃষক বিদ্রোহ, যা মূলত সাঁওতাল কৃষকদের নিয়ে গঠিত ও ইলা মিত্র এই আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিলেন। এটি তেভাগা আন্দোলনেরই একটি অংশ ছিল, যেখানে কৃষকরা জমিদারদের শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল। এটিও তেভাগা দাবিতে সংঘটিত হলেও পৃথক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লড়াই-সংগ্রাম, দমন-পীড়নের কারণে ইতিহাসে নাচোল বিদ্রোহ নাম অভিহিত। যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ভাগাভাগি নিয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে নাচেল কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কমিউনিটি পার্টি ও কৃষক সমিতির নেত্রী ইলা মিত্র। কৃষক আন্দোলন-সংগ্রামের সময় পুলিশের হাতে আটক হয়ে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। স্বামী কমরেড রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে ভারতের মালদহের নাবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্র হাটের শ্বশুরের জমিদার বাড়িতে দিনাজপুর চলে আসেন তিনি। ইলা মিত্র ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতান সংগ্রামী, ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে ইলা মিত্রকে নিয়ে নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হয়। বার বার দাবি উঠে তার পৈত্রিক ভিটা দখলমুক্ত করার। ২০১১ সাল থেকে সাংগঠনিকভাবে ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ঝিনাইদহ, শৈলকুপা ও ঢাকায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্বারকলিপি পেশ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় পুরাকীর্তি হিসেবে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য গেজেট প্রকাশ করেন। তবে প্রত্নসম্পদ ঘোষণার প্রায় ৯ বছরেও জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়িটি সংরক্ষণে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একইসাথে ইলা মিত্রের বাড়ি পর্যন্ত পাকা রাস্তা, ইলা মিত্রের নামে জাদুঘর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র, ছাত্রীনিবাস ও সড়কের নামকরণের গণদাবিতে আন্দোলন চলমান রয়েছে বলে জানান কমরেড ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ সদস্য সচিব ও জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ আহ্বায়ক সুজন বিপ্লব।
কিংবদন্তি ইলা মিত্রের স্মৃতি সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ প্রায় ৯ বছর পার হলেও তাদের কোনো ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ করলেন ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ আহ্বায়ক আব্দুর রহমান মিল্টন।
মহিয়সী বিপ্লবী ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি দ্রুত দখলমুক্ত করে তার সংগ্রামী জীবনকে ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ঝিনাইদহ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড আবু তোয়াব অপু।
বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে জানান ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল। এদিকে শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নিগ্ধা দাস বলেছেন, বাড়িটিতে বর্তমানে যারা বসবাস করছেন তাদের দাবি তারা সম্পদটি কিনে নিয়েছেন। এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশের পর জমি অধিগ্রহণের কোনো নির্দেশনা আসেনি।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ঝিনাইদহ ও শৈলকুপায় ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটা ও স্মৃতি সংরক্ষণে দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। ২০১১ সালে সাংগঠনিকভাবে ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক এই আন্দোলনের সূচনা থেকে সংরক্ষণের রাষ্ট্রীয় গেজেট প্রকাশের বিজয় অবধি কর্মসূচি জারি রেখেছে। অত্র দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন ও স্মারক লিপি পেশসহ আন্দোলনের সংবাদের কথা উল্লেখ করে ভোরের কাগজ ও কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রত্নসম্পদ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় মহীয়সী বিপ্লবী ইলা মিত্রের ঘনিষ্ঠ কমরেড-ভাষা সংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও লেখক প্রয়াত ডা. আহমদ রফিক রচিত কলাম প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইলা মিত্র স্মৃতি রক্ষা আন্দোলন, ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ ও ঝিনাইদহ ইলা মিত্র সংরক্ষণ পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান রয়েছে। বাড়িটি প্রকৃতপক্ষে দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস রচিত হবে। সেই লক্ষ্যে লড়াই চলমান এখনও স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী, ক্ষেতমজুর সমিতি, কৃষক সমিতি, সিপিবি, কমরেড ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, ইলা স্মৃতি রক্ষা আন্দোলন ও ঝিনাইদহ ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের যৌথ নেতৃত্বে ইলা মিত্র পৈত্রিক বাড়ি ও স্মৃতি রক্ষা আন্দোলন সফভাবে সংগঠিত হয়। একইসাথে ইলা মিত্রের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পাকা, ইলা মিত্রের নামে মিউজিয়াম, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র, ছাত্রীনিবাস ও সড়কের নামকরণের গণদাবিতে আন্দোলন চলমান রয়েছে।
পিতৃভূমি সম্পর্কে ইলা মিত্রের জীবদ্দশায় জানা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির রজতজয়ন্তী ও তেভাগা আন্দোলন ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন নাচোল কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তি ইলা মিত্র। রাজধানী ঢাকা, নাচোল ও যশোরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যশোরে গিয়ে শৈলকুপার সিপিবি নেতা আবু কালাম আজাদ ও ডা. হাবিব খানসহ কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ বাগুটিয়া গ্রামের পৈতৃক ভিটাবাড়ির মাটি তার হাতে দেন। শ্রদ্ধাভরে শৈলকুপার বাগুটিয়ার রায়পাড়ার পিতৃভূমির মাটি ছুঁয়ে সপরিবারে আগমনের প্রত্যয় জনসম্মুখে ব্যক্ত করেন। পরে সমায়াভাবে ভারতে ফিরে যান।
বিপ্লবী ইলা মিত্র’র জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯২৫ আর ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। গরীব, দুঃখী, সাঁওতাল, আদিবাসী, নাচোল কৃষক আন্দোলনের নেত্রী কমরেড ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটা-বাড়ি সংরক্ষণে দুই যুগের অধিক সময় ধরে আন্দোলন চলমান থাকলেও সংরক্ষণের প্রশ্নে সরকারের ঘোষণাকে এড়িয়ে চলাকে স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। ধ্বংসপ্রায় এই ঐতিহাসিক বাড়িটির জন্য জমি অধিগ্রণ ও বসবাসরতদের অন্যত্র পুনর্বাসন না করা হলে শুধু বাড়িটি নয়, ইতিহাস থেকে মুছে যাবে কিংবদন্তি ইলা মিত্রের স্মৃতি। যে মানুষটি সারাজীবন মানুষের ভূমি অধিকারের জন্য জীবনবাজি রেখে লড়ে গেছেন, তিনিই আজ ভূমিহীন, তাঁরই পৈতৃক বাড়ি অন্যের দখলে।