মামুন হোসেন-
বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, দৈনিক বাংলাভূমি–এর প্রধান সম্পাদক সাঈদুর রহমান রিমনের হঠাৎ মৃত্যুতে গাজীপুর প্রেসক্লাবজুড়ে নেমে আসে এক শোকের ছায়া। শ্রদ্ধা, অশ্রু আর স্মৃতির মিছিলে শনিবার সকাল ১১টায় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা ও মিলাদ মাহফিল।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই আপোষহীন সাংবাদিক। তাঁর মৃত্যু যেন সাংবাদিকতার অঙ্গনে এক শূন্যতা নয়—একটা যুগের অবসান। “একটি কলম নীরব হলো, একটি সাহস থেমে গেল।”
স্মরণসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত রিমনের সহধর্মিণী চামেলি রহমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলাভূমি–এর সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম আজহার। সঞ্চালনায় ছিলেন কবি, লেখক ও বিশেষ প্রতিনিধি শাহান সাহাবুদ্দিন। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন হাফেজ ফাহিম আহম্মেদ।
সভায় গাজীপুর প্রেসক্লাব ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা আবেগময় ভাষায় স্মরণ করেন রিমনের জীবনের নানা অধ্যায় তাঁর নির্ভীকতা, সততা ও পেশাদারিত্ব। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে চোখ ভিজলো বক্তাদের। গাজীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান টিটু বলেন, “রিমন ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রনিনাদ। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার সাহসী প্রতিচ্ছবি।”
সাবেক সভাপতি নাসির আহমেদ বলেন, “সত্য প্রকাশে কোনো ভয় ছিল না তাঁর। রিমনের মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিক আজও বিরল।”
খায়রুল ইসলাম যুক্ত করেন, “রিমন ছিলেন নৈতিকতার বাতিঘর—যেখানে সাংবাদিকতা ছিল নৈতিক দায়িত্ব, আর সমাজ ছিল তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র।”
বাংলাভূমি সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজহার বলেন, “রিমন ভাইর স্বপ্ন ছিল পত্রিকাটিকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। আজ তা সত্য হয়েছে তাঁরই হাতে গড়া সাহস ও সত্যের চিত্রপট দিয়ে।”
বিশেষ প্রতিনিধি শাহান সাহাবুদ্দিন কণ্ঠরোধক আবেগে বলেন, “মৃত্যুর আগের রাতে বনবিভাগের ওপর অনুসন্ধানী সংখ্যা সম্পাদনা করেন রিমন ভাই। সকালে হিলফুল একাডেমি পরিদর্শনে যান, আর ফিরে এলেন না। আমরা চারজন সেদিন রাতে একসাথে কাজ করেছিলাম। তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, প্রজ্ঞার আশ্রয়।”
মো. মোজাহিদ, মিঠুন সিদ্দিকী, নুর আলম সিদ্দিকী মানু, আব্দুস সাত্তার শান্তসহ আরও অর্ধশতাধিক সাংবাদিক স্মৃতিচারণায় অংশ নেন। অনেকেই আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। ভাঙা গলায় প্রার্থনার ছায়া অনুষ্ঠান শেষে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। দোয়া পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের খতিব মাওলানা মো. মনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “একজন মানুষ কতজনের দোয়ার কেন্দ্র হতে পারেন—রিমন তার জীবন্ত প্রমাণ। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।” কলম থেমে যায়, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা নয়। সাঈদুর রহমান রিমনের চলে যাওয়া শুধু একজন সাংবাদিকের মৃত্যু নয়—এটি ছিল এক সাহসী কণ্ঠস্বরের নীরব হয়ে যাওয়া। তাঁর প্রতিটি প্রতিবেদন ছিল সমাজের অন্ধকারে আলোর মশাল। তিনি ছিলেন শোষকের মুখোশ উন্মোচনের নাম। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় যে আলোকবর্তিকা তিনি জ্বালিয়ে গেছেন—তা কখনো নিভে যাওয়ার নয়। আজ, বাংলাভূমি পরিবার যে আয়োজনে তাঁকে স্মরণ করল, তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়- এ যেন কলমের কান্নায় লেখা ইতিহাস। সাঈদুর রহমান রিমন ছিলেন, আছেন, এবং থাকবেন সাংবাদিকতার হৃদয়ে। তাঁর নামই আজ এক অনল জাগানিয়া প্রতীকের নাম। তাঁর না-থাকা আমাদের নিঃস্ব করে দিলো।